আতিক ফারুক

লেখক

এখানে আরেকটু রোদ

২ আগস্ট ২০১৯

এখানে আরেকটু রোদ

জাহিদুর রহিমের আলোচনা

একান্ত ও অফুরন্ত-রূপে সাহিত্য থেকেই সাহিত্যের জন্ম: কী লিখবো, সে-কথা কবিকে কানে-কানে ব’লে দিয়ে যায় বিশ্ব বা জীবন বা বিশ্বজীবন, বা বিশ্ব প্রকৃতি; কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে কী-লিখবো আর কেমন ক’রে লিখবো অবিভাজ্য ব’লে রচনার আদর্শ না থাকলে বক্তব্য বিষয়ও মনের মধ্যে স্পষ্ট না”- বুদ্ধদেব বসু ['কবিতা' পত্রিকা/ আশ্বিন ১৩৫৩ সংখ্যা।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী কবি টি এস এলিয়ট লিখেছিলেন, “Good poetry approximates a condition of good prose\"। এলিয়ট নিজে বড় কবি, এমনকি নোবেল বিজেতা হবার পরেও সাহিত্য আলোচনায় কেন গদ্যকে এতো গুরুত্ব দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে ভেবেছি অনেক। সাহিত্যে ‘ফিকশন’ আর ‘নন-ফিকশনে’র ভাগ আলাদা হবার আগে সব তো ছিল মিলেমিশে। ফরাসি গদ্যের ‘নব নির্মাতা’ মিশেল মতেইন এর ‘essai’  থেকে আধুনিক ইংরেজী গদ্যের জনক  ফ্রান্সিস বেকনের ‘essay’- যে অনেক দূরত্বে অবস্থিত এটা যেন আলাদা বুঝালেন বেকনের নিজ ভাষার এই কবি। এবং ‘এই বুঝানো’ ইংরেজী ভাষার ‘নীরস’, ‘শুষ্ক’ ও ‘বিবর্ণ’  জগতের প্রতি বিরাগ থেকে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি এলিয়টের বক্তব্যের উল্টোটাও সত্য মনে করি। ‘ভালো গদ্যের কাজও ভালো কবিতার কাছাকাছি পৌছানো’ এবং একই সাথে আলাদা এক সুরে পাঠকের সাথে একাত্ম হওয়া। ‘বেলেস লেতার’ এর প্রকৃত প্রতিশব্দ হিসেবে ‘মনোরম গদ্য’ বা ‘অনুপম গদ্য’ বা ‘অন্তরঙ্গ গদ্য’ এমন লেখাই সমীচীন। এতে বাংলা অভিধানগুলোর যত না উপকার, এর বেশি উপকার হয় পাঠকের। লেখকের লেখা মূল্যায়নের দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা তৈরিতে কেবল নয়,  দরকার আধুনিক সাহিত্যের জটিল বিভাজনের সুস্পস্ট পথ নির্দেশের তাগিদে। এই কথাগুলো ভূমিকা হিসেবে নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

ব্যক্তি জীবন, বিশ্বজগত আর মানব জগতের সত্যকে হৃদয়ের রসে ভিজিয়ে সময়ের ডালিতে করে অর্ঘ্য দিয়েছেন তিনি ‘মিথ্যের সংসারে’।

দু-দিন আগে আতিক ফারুকের গদ্যের বই ‘এখানে আরেকটু রোদ’ হাতে পেলাম। পড়া ও লেখা উভয় ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত ‘নৈরাজ্যের’ সাক্ষী হয়ে একই সাথে আরও কিছু বইয়ের সাথে এই বই পড়ে ফেললাম। পাঠক হিসেবে যে কোন গদ্য পড়ার সময় আমি দেখতে চাই সেই গদ্যের ‘ক্রমগতি’ বা ‘বিন্যস্ততা’। বিষয় বা আঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ স্বীকার করে নিয়েই বলতে চাই , লেখকের জন্য ‘লেখার ভেতরে গতিশীল থাকা’ই লেখক হিসেবে বিকাশের জন্য প্রথম শর্ত। যে কোন লেখা মূল্যায়নের জন্য বড় আলোচনা, অনুসন্ধান ও সময় সাপেক্ষ বিশ্লেষণ দরকার, আর কেউ হয়ত করবেন, আমি শুধু এই বইয়ে আতিক ফারুকের যে চলার দাগ সেটা চিহ্নিত করতে চাই।

গদ্য ও কবিতার  উপলব্ধি ও প্রকাশে দুই বিপরীত দর্শন কাজ করে। কবিতা বাইরের সব বোধের আলো টেনে এনে একান্ত অন্তরে ধারন করে। গদ্য করে উলটো কাজ। গদ্য কোন একান্ত অনুভবকে বাইরের দৃশ্য প্রফুল্লতায় ধারন করে প্রকাশ করে। আতিক সময়, জীবন ও বোধের মিশেলে গড়া চেনা মাটিতেই নিজেকে মিলিয়েছেন। এজন্যই তাঁর গদ্যের স্বর আলাদা, নরম ও আন্তরিক। ব্যক্তি জীবন, বিশ্বজগত আর মানব জগতের সত্যকে হৃদয়ের রসে ভিজিয়ে সময়ের ডালিতে করে অর্ঘ্য দিয়েছেন তিনি ‘মিথ্যের সংসারে’। সেই ‘সত্যের স্বরূপ’ , ‘রসের ঘনত্ব’ আর ‘ডালির বিশালতা’- কোন অধ্যাপক বা গবেষক লিখুক, আমি কেবল লিখবো কি আছে সেই ডালিতে।

লেখক যেন পথ খুঁজ্‌ছেন এক আলাদা প্রকরণ সৃষ্টির, একটা অদ্ভুত তাড়না আছে নিজেকে প্রকাশের পথ করে নিতে।

‘এখানে আরেকটু রোদ’- বইয়ে লেখক ‘পরিচ্ছন্ন এক বোধ’ দিয়ে অন্যমনস্ক চোখ ও কানকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করেন। আর পাঠকের  অনুভূতিকে এমন করে নাড়িয়ে যান, যেন পুনরায় তা আবার ভারসাম্যে ফিরে আসে। যেন যা পাঠক আশা করছ, তা না মনে হলেই বরং (পাঠক) নিজেকে খুঁজে পাবে আরেক ভাবনা আর ভুবনে। আর সে কারণেই পাঠকের জন্য তা হয়ে উঠবে আরও মুগ্ধকর, প্রত্যাশাহীন উত্তেজনাময় এক পথ চলা। আমার কেন যেন মনে হয়েছে আতিকের গদ্য  কোন কোন ক্ষেত্রে ‘অতিমার্জিত’, লেখার কোন কোন স্থানে ‘গদ্যের প্রসঙ্গ’ ও ‘প্রসঙ্গের ভাঙ্গন’ আছে। লেখক ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় সেই ভাঙ্গনে বার বার পা রেখেছেন।

গদ্যে আমি প্রতিজ্ঞা খুঁজি, খুঁজি নিজের মুক্তির এক ‘অবিকল্প আদর্শ’।

গদ্যে আমি প্রতিজ্ঞা খুঁজি, খুঁজি নিজের মুক্তির এক ‘অবিকল্প আদর্শ’। এটা একান্ত নিজের। যদি তা ধরা না পড়ে, গদ্যের ভাষা যতই মরিচিকাময় হোক, যতই সহজপাচ্য মুগ্ধতা আনুক, পাঠক হিসেবে আমার কাছে সেটার স্থায়িত্ব থাকে না। ‘এখানে আরেকটু রোদ’- বইয়ে লেখক আপন ‘গদ্যের স্বর’ খুঁজেছেন প্রতি অক্ষরে। আত্ম-অনুসন্ধানের এক তাড়না আছে, যেখানে তিনি যেতে চান। সে তাড়নার সব কিছু জুড়ে একটা যত্ন আর সহৃদয় উপস্থিতির অনুভবও আছে সর্বত্র। লেখক যেন পথ খুঁজ্‌ছেন এক আলাদা প্রকরণ সৃষ্টির, একটা অদ্ভুত তাড়না আছে নিজেকে প্রকাশের পথ করে নিতে। সেই পথ খুঁজতে থাকাই তো আসল পথ , এই অন্বেষণের নির্মিতিই তো শিল্প।

২০১৯ সালে প্রকাশিত বই।